
উৎপাদন না করেও নিচ্ছে ভাড়া
বিদ্যুৎখাতে লুটপাট
- আপলোড সময় : ১৭-০৮-২০২৪ ০২:০২:৩৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৭-০৮-২০২৪ ০২:০২:৩৪ অপরাহ্ন


পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় প্রায় সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এরপরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় প্রায় ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা
বিদ্যুৎখাতে ব্যাপক লুটপাটের তথ্য বেড়িয়ে আসছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কেন্দ্র ভাড়া পরিশোধ করতে বিদ্যুৎখাতে বেড়েছে ভর্তুকি। গত ১৫ বছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি পেমেন্টই (কেন্দ্র ভাড়া) দেয়া হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদন না করেও অনেক কেন্দ্র অলস বসে থেকে পেয়েছে ভাড়া। এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগেরই মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বলে সূত্রে জানা যায়। পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় প্রায় সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় প্রায় ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
২০০৮ সালে বিদ্যুৎখাতে ৯০০ কোটি টাকা ভর্তুকি থাকলেও তা পরে কেন্দ্র ভাড়ার কারণে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। কারণ ভর্তুকির ৮৫ শতাংশই গেছে কেন্দ্র ভাড়ায়। ভর্তুকি কমাতে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম; যা যাচ্ছে গ্রাহকের পকেট থেকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আটটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। ওই বছর আওয়ামী লীগের সরকার বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা জরুরি বিশেষ আইন এখনো আছে। এই আইনের অধীনেই ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেয়া হয়।
বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এরমধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম। অভিযোগ আছে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দক্ষতায় চালানো হয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই অলস বসে ছিল।
দরপত্র এড়াতে বিশেষ আইন: ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দরপত্র এড়াতে সংসদে পাস করা হয় ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’। এই আইনে করা কোনো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না, যাওয়া যাবে না দেশের আদালতে। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক দুই কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ আইনের অধীনে ৮২টি আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গত ১৩ বছরে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে শুধু কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিডিবি গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের ভুল নীতির কারণে লোকসান গুনেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসান প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ১৫ বছর আগে বছরে লোকসান ছিল মাত্র ৮২৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে লোকসান দেয় ৫১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই বিপুল অর্থ সরকারের অর্থ বিভাগ ধার হিসেবে দেয় পিডিবিকে। তবে অর্থ বিভাগের কাছে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় এখন পিডিবিকে টাকা দিতে পারছে না। কারণ পিডিবি দেনা শোধ করে মার্কিন ডলারে। রিজার্ভের ওপর টান পড়ায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরাও পিডিবির কাছে বিদ্যুতের বিল পাবেন। বিগত সরকার বন্ড ইস্যু করেও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি।
বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, দেশের বিদ্যুৎ খাত খোলা হয়ে গেছে। ভেতরে কিছু নেই। ক্যাবের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও আমলে নেয়া হয়নি। এ মুহূর্তে দেশের সব উন্নয়ন বন্ধ রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ওপর নজর দিতে হবে, তা না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত যদি ধসে যায়, তবে গোটা অর্থনীতি বালুর বাঁধের মতো তছনছ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সব চুক্তি খতিয়ে দেখতে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এই টাস্কফোর্স চুক্তি খতিয়ে দেখে বাতিল করার পরামর্শ দেবে এবং কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্টের যৌক্তিক পুনর্মূল্যায়ন করবে। আগামী তিন বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো যাবে না। এসব না করা গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি যে ডুবছে, তাকে আর ভাসানো যাবে না।
গত ১৩ বছরে বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। এই গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি ও সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানদের পারিবারিক ব্যবসা। সামিটের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এগুলো পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। জানা গেছে, কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার দিক থেকে এই গ্রুপটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে, তাদের ছয়টি কেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা।
কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাক্যাটের চার বিদ্যুৎকেন্দ্র, ৮৮৩ কোটি টাকা। ষষ্ঠ সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্প ৭৮৫ কোটি, সপ্তম স্থানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি ৬৮০ কোটি, নবম স্থানে ডরিন গ্রুপের ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬৫১ কোটি এবং ১০ম স্থানে দেশ এনার্জির চার বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫১৫ কোটি টাকা। ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী। দেশ এনার্জি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান।
প্রয়োজন ছাড়াই বেড়েছে মেয়াদ: ক্ষমতাচ্যুত সরকারের দেয়া তথ্যমতে, দেশে প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। গ্রীষ্মে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ মাস পিক আওয়ারে (সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত) সর্বোচ্চ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় ১৬ হাজার থেকে ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ পিক আওয়ারেই সক্ষমতার অন্তত ৪০ শতাংশ কেন্দ্র বসে থাকে। এরপরও গত বছর পাঁচটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়, যেগুলোর সম্মিলিত ক্ষমতা ৬০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এই কেন্দ্রগুলো তিন বছরের মেয়াদে এসেছিল। ওই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর মালিক লাভসহ বিনিয়োগও তুলে নিয়েছেন। এরপরও দফায় দফায় কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ানোর কারণে এসব কেন্দ্রের জন্য বছরে গুনতে হবে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো এসব কেন্দ্র হলো সামিটের নারায়ণগঞ্জে ১২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র, কেরানীগঞ্জে পাওয়ারপ্যাকের ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ্-বাংলার মেঘনাঘাটের ১০০ মেগাওয়াট ও আইইএলের ১০০ মেগাওয়াট, জুলদার ১০০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জে ৫০ মেগাওয়াট ও ফেঞ্চুগঞ্জে ৫০ মেগাওয়াট।
কেরানীগঞ্জে পাওয়ারপ্যাকের কেন্দ্রটির ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ রয়েছে। কেন্দ্রটির মালিক সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সিকদার গ্রুপ।
পিডিবির এক প্রকৌশলী বলেন, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে শর্ত দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ না দিলে বসে বসে কেন্দ্র ভাড়া পাবে না। তবে বাস্তবে তাদের এমন সব শর্ত দেয়া হচ্ছে, তাতে অলস বসে থেকেও অর্থ পাবে, তবে তার নাম হবে রক্ষণাবেক্ষণ।
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ